কোটা ইস্যু সমাধানে সরকারের হাতে কী বিকল্প আছে?
9 JULY 2024
জান্নাতুল তানভী / বিবিসি নিউজ বাংলা, ঢাকা
সোমবার শিক্ষার্থীরা বাংলা ব্লকেড কর্মসূচি পালন করে
সরকারি চাকরিতে কোটা ব্যবস্থা বাতিলের দাবিতে এক সপ্তাহের বেশি সময় ধরে বাংলাদেশের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয় ও কলেজের শিক্ষার্থীদের আন্দোলনের প্রেক্ষাপটে সরকার দাবি করছে, এ সমস্যার সমাধানে তারা আদালতের উপরই নির্ভর করছে।
গত দুইদিন শিক্ষার্থীদের আন্দোলনে পুরো ঢাকা শহর কার্যত অচল ছিল।
সরকারের দায়িত্বশীল পর্যায় থেকে বলা হচ্ছে, আদালতে বিচারাধীন থাকায় সেখানেই কোটার বিষয়টি সমাধান হতে হবে। বিচারাধীন বিষয়ে সরকার কথা বলবে না।
এমন প্রেক্ষাপটে প্রশ্ন উঠেছে, চলমান পরিস্থিতি বিবেচনায় নিয়ে রাজনৈতিকভাবে এ সমস্যার সমাধান আদৌ সম্ভব কি না? এই অবস্থায় সরকারের হাতেই বা কী ধরনের বিকল্প আছে?
যা বলছে শিক্ষার্থীরা
২০১৮ সালে কোটা সংস্কার করে ১০ শতাংশ করার দাবিতে আন্দোলনে নামে বাংলাদেশ সাধারণ ছাত্র অধিকার সংরক্ষণ পরিষদ। এক পর্যায়ে সরকার ওই বছর নবম থেকে ১৩তম গ্রেডের (প্রথম ও দ্বিতীয় শ্রেণি) সরকারি চাকরিতে কোটা বাতিল করে।
কয়েকজন মুক্তিযোদ্ধার সন্তান ২০২১ সালে হাইকোর্টে রিট করলে গত পাঁচই জুন এক রায়ের মাধ্যমে আবারও ফিরে আসে কোটা। হাইকোর্টের ওই রায় স্থগিত চেয়ে রাষ্ট্রপক্ষ আবেদন করে আপিল বিভাগে। সেই আবেদন গত চৌঠা জুলাই শুনানির জন্য আসলে রাষ্ট্রপক্ষকে লিভ টু আপিল করতে নির্দেশ দেয় সর্বোচ্চ আদালত।
এরই মধ্যে গত পহেলা জুলাই থেকে কোটা বাতিলে আন্দোলনে নামে শিক্ষার্থীরা। এই আন্দোলন এখন ছড়িয়ে পড়েছে দেশব্যাপী। বৈষম্য-বিরোধী ছাত্র আন্দোলনের ব্যানারে শিক্ষার্থীরা এই আন্দোলন চালিয়ে যাচ্ছে।
‘বাংলা ব্লকেড’ নামে গত দুইদিন ধরে শিক্ষার্থীরা যে কর্মসূচি পালন করেছে তাতে ঢাকা এবং ঢাকার বাইরে বিভিন্ন সড়ক ও মহাসড়ক বন্ধ হয়ে যায়।
আন্দোলনকারী শিক্ষার্থীরা জানান, এখন এক দফা দাবিতে আন্দোলন চলছে। গত দুই দিনের বাংলা ব্লকেড কর্মসূচির ধারাবাহিকতায় আবারো কর্মসূচি ঘোষণা করা হবে। শিক্ষার্থীদের দাবি আদালতের কাছে নয় বরং সরকারের কাছে তাদের এই এক দফা দাবি।
শিক্ষার্থীদের এ আন্দোলনের সমন্বয়ক নাহিদ ইসলাম বিবিসি বাংলাকে বলেন, “এই এক দফা মূলত সরকারের এখতিয়ারের বিষয়। সকল গ্রেডের কোটায় যৌক্তিক সমাধান করে সংসদে বিল বা আইন পাশ করে নতুন পরিপত্র জারি করতে পারে সরকার।”
এটি সম্পূর্ণ সরকারের এখতিয়ার উল্লেখ করে মি. ইসলাম বলেন, “সরকার তার দায় এড়াতে আদালতকে সামনে রাখছে বা ব্যবহার করছে।”
বৈষম্যমূলক কোটা বাতিল করে সংবিধান অনুযায়ী কেবল অনগ্রসর জনগোষ্ঠীর জন্য কোটা রেখে সংসদে আইন পাশ করে সরকার নতুন করে প্রজ্ঞাপন জারি করতে পারে বলে মনে করছেন আন্দোলনকারী শিক্ষার্থীরা।
একইসাথে এখনই কোনো আইনি প্রক্রিয়ায় শিক্ষার্থীরা অংশগ্রহণ করবেন না বলে জানান মি. ইসলাম।
“আদালতে যেহেতু রাষ্ট্রপক্ষই আপিল করেছে, এখানে আমাদের অংশগ্রহণের কোনো প্রয়োজন নেই। যেহেতু এই দাবিটি সরকারের কাছে, সরকারই এখানে পদক্ষেপ নিতে পারে। আদালতের প্রতি সম্পূর্ণ শ্রদ্ধা আছে, আইনি প্রক্রিয়া তার মতো চলবে। আমরা আমাদের রাজপথের আন্দোলন এগিয়ে নিয়ে যাবো,” বলেন মি. ইসলাম।
এদিকে, হাইকোর্টের রায় স্থগিত চেয়ে চেম্বার জজ আদালতে আবেদন করেছেন দুইজন শিক্ষার্থী।
বুধবার আপিল বিভাগের পূর্ণাঙ্গ বেঞ্চে এই আবেদনের শুনানি হবে বলে নির্দেশ দিয়েছেন চেম্বার বিচারপতি।
এই শিক্ষার্থীরা আগের ওই আবেদনে পক্ষভুক্ত হতে চেয়েছেন বলে জানিয়েছেন আইনজীবীরা।
আদালতে করা এই আবেদনের পরই এই আন্দোলনের আরেকজন সমন্বয়ক আব্দুল হান্নান মাসউদ নিজেদের গ্রুপে এক খুদে বার্তায় বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন থেকে কোনো প্রতিনিধি হাইকোর্টে যায়নি বলে নিশ্চিত করেন।
একইসাথে নির্বাহী বিভাগের কাছে এক দফা দাবি করা হয়েছে বলে উল্লেখ করা হয়। দাবি পূরণ না হওয়া পর্যন্ত কর্মসূচি চালিয়ে যাওয়ার ঘোষণাও দেয়া হয় ওই বার্তায়।
আদালতের বাইরে সমাধান কী সম্ভব?
কোটা সংস্কারে শিক্ষার্থীদের দাবি বিকল্প উপায়ে সমাধান করা সম্ভব বলে মনে করছেন আইনজীবীদের অনেকে।
তারা বলছেন, কোটা বাতিলের প্রজ্ঞাপনকে আদালত অবৈধ ঘোষণা করায় এ ব্যবস্থা আবার বহাল হয়েছে। ফলে কোটা সংরক্ষণ করে পূর্বের যে প্রজ্ঞাপন রয়েছে সেটিতে গ্রহণযোগ্য হারে কোটা রেখে একটি সংশোধনী এনে সমস্যার সমাধান করা যায় বলে জানান আইনজীবীরা।
সুপ্রিমকোর্টের জ্যেষ্ঠ আইনজীবী শাহদীন মালিক বিবিসি বাংলাকে বলেন, “আদালত কোটা বাতিলের প্রজ্ঞাপন অবৈধ ঘোষণা করায় তা বাতিল হয়েছে। ফলে ৫৬ শতাংশ কোটা সংরক্ষণ করে আগের প্রজ্ঞাপনটি পুনর্বহাল হলো।”
“আদালতের আদেশ মেনে আগেরটি পুনরুজ্জীবিত করে এখন কার্যকর করা যায়। এরপর একমাসের মধ্যে সেটিকে যৌক্তিকভাবে সংশোধন করে আরেকটি প্রজ্ঞাপন দিতে কোন বাধা নেই।”
সংবিধান অনুযায়ী, নারী, প্রতিবন্ধী, ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠী এবং অনগ্রসর ব্যক্তিদের জন্য কোটা সংরক্ষণ করা যায়। তবে সেটি ১০ থেকে ১২ শতাংশ অর্থাৎ যৌক্তিক হারে হতে পারে বলে মনে করেন এই আইনজীবী।
“সবার সাথে কথা বলে প্রতিবন্ধী, নারী, অনগ্রসর ব্যক্তিদের জন্য একটা নির্দিষ্ট হারে কোটা রাখলে আইনের চোখে সবাই সমান এর লঙ্ঘন হবে না। কিন্তু মুক্তিযোদ্ধার সন্তানদেরই এখন বয়স পেরিয়ে গেছে। সেক্ষেত্রে নাতি-পুতিদের জন্য কোটা সংরক্ষণ করা অযৌক্তিক,” বলেন মি. মালিক।
প্রায় একইমত পোষণ করেছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগের অধ্যাপক আসিফ নজরুল।
বিবিসি বাংলাকে মি. নজরুল বলেন, “সরকারের দুইটা জিনিস করার আছে। অ্যাটর্নি জেনারেল অফিস সরকারের অংশ। তাদের আন্তরিকভাবে আপিল বিভাগে এটা নিয়ে লড়তে হবে। লিগ্যাল ওয়েতে হাইকোর্টের রায়টা বাতিল করার চেষ্টা করেন।”
“তারপরও হাইকোর্টের রায়ে বাতিলের পরিপত্র অবৈধ হওয়ায় আগেরটা রয়ে গেছে। তাহলে সেটাকে সংশোধন করেন। সরকার পরিপত্র সংশোধন করতে পারবে না এটা পৃথিবীর কোন আইনে রয়েছে! এটাতো কমনসেন্সের ব্যাপার। যদি সেই পরিপত্রটা আপিলেট ডিভিশন পর্যন্তও টিকে যায় তবেও এটিকে সংশোধন করা যায়,” বলেন মি. নজরুল।
যদিও আদালতের বাইরে এখন আর এ সমস্যার সমাধান করার কোনো সুযোগ নেই বলে মনে করছেন রাষ্ট্রের সর্বোচ্চ আইন কর্মকর্তা।
“সরকার যে আদেশ দিয়েছিল সেটা আদালতে বাতিল হয়েছিল। যা কিছু করতে হবে আদালতেই করতে হবে। ফলে এটা সরকারের এখন কিছু করার সুযোগ নেই,” বিবিসি বাংলাকে বলেন অ্যাটর্নি জেনারেল এ এম আমিন উদ্দিন।
মি. উদ্দিন বলেন, “আদালতের বাইরে এখন কিছু করতে গেলে সেটা আদালত অবমাননা হবে। এটা অবৈধ হবে। কারণ সরকারের প্রজ্ঞাপনটাই বাতিল হয়ে গেছে। ফলে সুপ্রিমকোর্টের পরবর্তী আদেশের জন্য এখন অপেক্ষা করতে হবে।”
সচিবালয়ে শিক্ষার্থীদের এ আন্দোলন নিয়ে সরকারের অবস্থানের বিষয়ে সাংবাদিকরা জানতে চাইলে আইনমন্ত্রী আনিসুল হক প্রধানমন্ত্রীর কথা উল্লেখ করেন।
তিনি জানান, প্রধানমন্ত্রী অত্যন্ত স্পষ্ট করেই বলেছেন সরকারের সিদ্ধান্তের ব্যাপার নেই এখন, কোটার ইস্যুটা এখন সর্বোচ্চ আদালতের কাছে আছে।
মি. হক বলেন, “ঘটনা ঘটেছে আদালতে। রাজপথে আন্দোলন করে, এটার নিরসন হবে না। এভাবে আন্দোলন করলে এক পর্যায়ে হয়তো আদালত অবমাননাও হয়ে যেতে পারে। সেক্ষেত্রে কোটা সমস্যা নিরসনের সঠিক জায়গা হচ্ছে আদালত।”